ঈদে তাঁতীদের হাতে বোনা ‘স্বপ্ন’ তাঁতের শাড়ি ।। SHOMOY SANGBAD - সময় সংবাদ | Popular Bangla News Portal

Breaking

Post Top Ad

Responsive Ads Here

শনিবার, জুন ০৯, ২০১৮

ঈদে তাঁতীদের হাতে বোনা ‘স্বপ্ন’ তাঁতের শাড়ি ।। SHOMOY SANGBAD

ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ি-৫

জাহাঙ্গীর আলম, টাঙ্গাইল

মসৃণতার ছোঁয়ায় বারবার উদ্ভাসিত হয় বাঙালি নারীর চিরায়ত যে স্নিগ্ধ সৌন্দর্য, তার নাম শাড়ি- তাঁতের শাড়ি। তাই শতবর্ষ পাড় করে এসে আজো উৎসব বা পার্বণে এ দেশের নারীরা নিজেদের জড়িয়ে নিতে চান মিহি বুননের নকশা করা পাড়ের তাঁতের শাড়িতে। টাঙ্গাইলের তাঁতীদের হাতে বোনা শত বছরের স্বপ্ন ‘তাঁতের শাড়ি’। টাঙ্গাইলের তাঁতীরা হাতের নন্দিত কারুকাজে শতবছর পুরনো গল্পের জালে সুতার ভাঁজে ভাঁজে নকশার ডানা মেলা যেন সুন্দরী তন্বিকে জড়িয়ে নেন নখের ডগায়। তাঁতীদের সে গল্প কত মোড় ঘুরে, কত পথ পাড়ি দিয়ে, কত ইতিহাস গড়েছে- তার ইয়ত্বা নেই! এখনও খট্ খট্ শব্দে দিন-রাত নানা গল্প বলে চলে ব্যস্ত তাঁতের মাকুগুলো। 
মাকুর খট্ খট্ ভাষা যা-ই বলুক না কেন, একে পরিচালিত করছে যে নকশাকাররা, পুরুষানুক্রমে তাদের গল্পগুলোর পটপরিবর্তন হলেও মূল সুরের ব্যত্যয় খুব বেশি ঘটেনি। আসলে মিহি সুতার নিখুঁত বুননের কাপড় তৈরির ইতিহাস এ দেশে নতুন নয়। ঢাকাই মসলিন- যার মোহনীয়তা থেকে মুক্ত ছিলনা সে সময়ের রাজকীয় পরিবারের সদস্যরাও, যার বুননের সূ²তা ও কমনীয়তা সম্পর্কে আন্দাজ করা যায় একটা আংটির ভেতর দিয়ে সম্পূর্ণ কাপড়টি বের করে আনার গল্প থেকে। তবে শুরু থেকেই বিশেষ ধরনের কার্পাস তুলা থেকে তৈরি মসলিন যেমন ছিল একটু অবস্থাপন্ন পরিবারের লোকদের পোশাক, দেশজ সুতির তাঁতের কাপড়গুলো তৈরি হতো সাধারণ জনগণের ব্যবহারের জন্য। দুই ধরনের কাপড়েই একটি বিষয় নিশ্চিত করা হতো, তা হলো- হাতে বোনা নিখুঁত সুতার কাজ, যাঁর ভাঁজে ভাঁজে থাকতো তাঁতীদের স্বপ্ন। 
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বেড়াজালে হারিয়ে গেছে মসলিন, বিশ্বায়নের জোয়ার এসেছে দেশের তাঁত শিল্পেও। অথচ সবকিছুর পরও শতবছর পাড় করে এখনো থেমে যায়নি তাঁতীদের ব্যস্ততা। নানা উত্থান-পতনের পাল্লায় পড়ে জর্জরিত হয়ে আজও কোনো উৎসবের আয়োজনে হঠাৎই তাঁতীদের সরব হয়ে উঠতে দেখা যায়। বিশ্বায়নের পরশ লেগেছে এ দেশের তাঁতের মাকুগুলোতেও। মেধাশক্তি ব্যবহার করে প্রযুক্তির ছোঁয়া লাগানো হয়েছে এতে, নকশায়ও আনা হচ্ছে নতুনত্ব। তবে মূল যে স্নিগ্ধতা আর মসৃণতা এ সুতার বুননকে প্রাচীনকাল থেকেই করে তুলেছিল এ দেশের নারীদের প্রিয়, সে স্নিগ্ধতার আমেজ বদলায় নি এখনও। 
টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইলে তাঁতী সীতানাথ রঞ্জিত বসাকের বাড়িতে ৩৬ বছর ধরে কাজ করছেন তাঁতী মো. সিফাত আলী। এখন চুলে পাক ধরেছে, প্রথম যখন আসেন এখানে- তখন বয়স বেশ কম। আটিয়া গ্রাম থেকে আড়াই মাইল পথ হেঁটে আসতেন এখানে কাজ করতে। পুরনো তাঁতীদের ওস্তাদ ধরে শিখেছিলেন তাঁত বুননের নানা কাজ। দীর্ঘ ৩৬ বছরে বদলে যেতে দেখেছেন অনেক কিছু। পুরনো মালিকরা বেঁচে নেই। চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে কাজের ধরনে এসেছে নানা পরিবর্তন। প্রবীণ এ তাঁতী বলেন, প্রযুক্তি ও আধুনিকায়নের সমন্বয় ঘটিয়ে এ ঐতিহ্যবাহী শাড়িগুলোর শিল্পগুণও প্রতিনিয়ত বাড়িয়ে তোলা হচ্ছে। 
কীভাবে এ অঞ্চলে তাঁতীদের পথচলা শুরু- সে সম্পর্কে মোহাম্মদ সিফাত আলী বলেন, বহুকাল আগে কিছু বসাক সম্প্রদায় এসে বসতি গেড়েছিল এ অঞ্চলে। প্রাচীনকাল থেকেই তাঁতের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন তারা। এখানকার তাঁত শিল্পের পত্তনও মূলত তাদের হাতেই। টাঙ্গাইল অঞ্চলে শুধু পাথরাইলেই নয়, কালিহাতী, ঘাটাইল, করটিয়া, দেলদুয়ারসহ আরো কিছু এলাকাকে ঘিরে গড়ে উঠেছে তাঁতপল্লী। ঐতিহ্য, নকশা আর গুণগত মানের কারণে এ অঞ্চলের তাঁতের শাড়িগুলোর পরিচিতি দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও রয়েছে।
যে শাড়ির নমনীয়তাকে শতবছর ধরে গায়ে মেখে নিচ্ছে এ দেশের নারীরা, সে শাড়ি তৈরি হয় কিন্তু অনেকগুলো ধাপ পাড়  করে, অনেকগুলো হাত ঘুরে। শাড়ি তৈরির জন্য শুরুতে সুতা সংগ্রহ করে তা মসৃণ করতে প্রক্রিয়াজাতের পর রঙ করে নিতে হয়। তারপর নকশা ঠিক করে নিতে হয়, পরে সেটিকে শাড়িতে ফুটিয়ে তোলা হয়। নকশাটিকে প্রথমে গ্রাফ কাগজে এঁকে তা থেকে ট্রেসিং বের করে সে নকশা অনুযায়ী সুতা সাজাতে হয়। এরপর সুতাকে মাকুতে ভরে নিয়ে শুরু হয় শাড়ি বুননের কাজ। প্রতিটা কাজই অত্যন্ত দক্ষতা ও সতর্কতার সঙ্গে করতে হয়।
চাহিদার বিপুল সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে শাড়ি তৈরির সনাতন পদ্ধতিতে এসেছে বেশকিছু পরিবর্তন, আধুনিকায়ন ঘটেছে তাঁতীদের পরম সঙ্গী পুরনো মাকুগুলোরও। সুতা তৈরি করা, রঙ করা বা শাড়ি বুননের কাজগুলো আজকাল করা হয় নানা দলে ভাগ হয়ে। প্রবীণ তাঁতীরা জানান, একসময় বন-জঙ্গলের লতা-পাতা এনে হাতেই সুতায় কাঁচা রঙ দেয়া হতো। এখন এ কাজেও প্রযুক্তির আশ্রয় নেয়া হয়। তাছাড়া মাকুতে যুক্ত হয়েছে নতুন কিছু খুদে যন্ত্রাংশ, ফলে কাজ করাটা এ সময়ের তাঁতীদের কাছে আগের চেয়ে সহজ মনে হয়। 
নকশা অনুযায়ী একেক শাড়ি বুনতে একেক রকম সময় লাগে। কোনো কোনো শাড়িতে একদিন, কোনোটিতে দুদিন, আবার কোনো কোনো শাড়ির বাহারি নকশায় একজন তাঁতীর এক মাসের শ্রমও ঢেলে দিতে হয়। শাড়ি তৈরির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রতিটা কাজই তাঁতীরা প্রখর মনোযোগের সঙ্গে করে থাকেন। সে কারণেই টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি বুননের উৎকৃষ্টতার সুনাম দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও পৌঁছে গেছে।
আজকাল মোহাম্মদ সিফাত আলীরা আর আড়াই মাইল হেঁটে তাঁতে কাপড় বুনতে আসেন না, আসেন সাইকেলে চড়ে। এর বেশি ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটেনি। ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না টাঙ্গাইলের তাঁতী পরিবারের প্রতিটা ঘরে ঘরে তাঁত বুনে যাওয়া দরিদ্র তাঁতীর। তবুও তাদের গর্ব হয় এই জেনে যে, অঙ্গপ্রত্যঙ্গের প্রতিটা অংশই কাজে লাগিয়ে বিপুল শ্রম-ঘাম ব্যয় করে যে মিহি জমিন আর নকশাদার পাড়ের তাঁতের শাড়ি তিনি বুনে যাচ্ছেন, তা নিয়ে গর্ব করে সারা দেশ। শত বছরের পুরনো এ ঐতিহ্যে হয় তো এভাবেই জমা হয়ে থাকে শতবর্ষ পাড় করে আসা এমন অনেক তাঁতীর সারা জীবনের স্বপ্ন।

Post Top Ad

Responsive Ads Here