ঈদ আনন্দে টাঙ্গাইল শাড়ির সাথে যোগ হয়েছে থ্রি-পিস ।।SHOMOY SANGBAD - সময় সংবাদ | Popular Bangla News Portal

Breaking

Post Top Ad

Responsive Ads Here

শনিবার, জুন ০৯, ২০১৮

ঈদ আনন্দে টাঙ্গাইল শাড়ির সাথে যোগ হয়েছে থ্রি-পিস ।।SHOMOY SANGBAD

ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ি-৪

জাহাঙ্গীর আলম, টাঙ্গাইল
‘নদী চর খাল-বিল, গজারির বন/ টাঙ্গাইল শাড়ি তার গরবের ধন’- এ প্রবাদেই মেলে টাঙ্গাইল শাড়ির পরিচয়। মান, নকশা আর বৈচিত্র্যই শুধু নয়, এ শাড়ির ঐতিহ্যও অনেক পুরনো। সে জন্য দেশ এবং দেশের বাইরের লক্ষ-কোটি বাঙালি রমণীর অন্যতম পছন্দ টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। এই শাড়ির কদর এখনও কমেনি বরং যোগ হয়েছে আধুনিকতা। যুগ ও সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে টাঙ্গাইল শাড়ির সাথে আরো যোগ হয়েছে, থ্রি-পিস/ফোর-পিস ও সালোয়ার-কামিজ। 
মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন-এখনও কাটাচ্ছেন টাঙ্গাইলের শাড়ির রাজধানী হিসেবে খ্যাত পাথরাইলের তাঁত সমৃদ্ধ এলাকার তাঁতশিল্পীরা। তবে তারা এবার শুধু শাড়ি তৈরি করছেন না, এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন বিভিন্ন নকশার থ্রি-পিস ও সালোয়ার-কামিজ। ঈদের চাহিদা মেটাতে জেলায় প্রায় ৭০ হাজার তাঁতে গড়ে ৩ লাখ তাঁতশিল্পী দিন-রাত কাজ করছেন। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত তাঁতের খট্ খট্ শব্দে টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল, নলশোধা, বাজিতপুর, টেগুড়ি, বীরপুষিয়া, গোপালপুর, নলসন্ধ্যা, চন্ডি, রূপসী, ডুলুটিয়া, কালিহাতী উপজেলার বল্লা, রামপুর, মমিননগর, কোকডহরা, নাগবাড়ি, কাজীবাড়িসহ বিভিন্ন এলাকার তাঁতীরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। তারা মেধা এবং শ্রম দিয়ে নিঁপুণ দক্ষতায় তৈরি করছেন ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ি- তৈরি করছেন সৌন্দর্যমন্ডিত থ্রি ও ফোর-পিস। টাঙ্গাইলের তাঁতীদের তৈরি থ্রি ও ফোর-পিস পড়তে যেমন আরামদায়ক দামেও তেমনি সস্তা। নানা মান ও রকমের থ্রি-পিস টাঙ্গাইলে পাওয়া যায়। কোন কোন নামী-দামি ব্র্যান্ডের শাড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানও এখন থ্রি-পিস/ফোর-পিস তৈরি করেছেন। অনিন্দ্য সুন্দর নকশার কারুকাজ ফুটিয়ে তুলছেন নকশাকারীরা। সাধারণ মানের একটি থ্রি-পিস/ফোর-পিসের দাম ৬৫০ থেকে ২৮০০ টাকা। এছাড়া ১২০০ থেকে ৮০০০ টাকার মধ্যে ভাল মানের থ্রি-পিস/ফোর-পিস ও সালোয়ার-কামিজ পাওয়া যায়। 
টাঙ্গাইলের তাঁতীদের তৈরি শাড়ি এলসির মাধ্যমে দেশের সীমানা পেড়িয়ে চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। ভারতের বাজারের বাড়তি আকর্ষণ এখন টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। টাঙ্গাইল শাড়ি কেনার জন্য দেলদুয়ারের পাথরাইল, কালিহাতীর বল্লা এলাকা সহ সদর উপজেলার করটিয়া, বাজিতপুর হাটে ভিড় করছেন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার শাড়ি ব্যবসায়ীরা। শাড়ির পাশাপাশি তারা এবার থ্রি-পিস/ফোর-পিস ও সালোয়ার-কামিজও কিনছেন। ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মহিলারাও তাঁত সমৃদ্ধ এলাকায় এসে পছন্দ অনুযায়ী শাড়ি ও থ্রি-পিস কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে এ সময় তাঁতীদের দিন-রাত পরিশ্রম করতে হচ্ছে। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও শাড়ি তৈরির কাজে তাঁতীদের সাহায্য করছেন। কিন্তু তারপরও চাহিদা অনুযায়ী শাড়ি সরবরাহ করতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। এ জন্য তাঁতীদের অতিরিক্ত শ্রম দিতে হচ্ছে। কিন্তু বাড়তি পারিশ্রমিক তারা পাচ্ছেন না। এর ফলে সীড লুম তাঁতীর সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এ অঞ্চলে ২০০১ সালে সীড লুম তাঁতীর সংখ্যা ছিল ২ হাজার ১৬২জন। বর্তমানে এ সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে ৯৮১ জনে। তাঁতের সংখ্যাও ৭ হাজার ৩৫ থেকে ১ হাজার ৪৮৯টিতে নেমে এসেছে।
পারিশ্রমিক প্রসঙ্গে তাঁতীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভাল একটি শাড়ি তৈরি করতে ৫-৭ দিন সময় লাগে। এ জন্য তারা পারিশ্রমিক পান ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা। বর্তমান দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধগতির বাজারে যা খুবই সামান্য।
অপরদিকে, সুতা ও রঙসহ শাড়ি তৈরির উপকরণের মূল্য দফায় দফায় বৃদ্ধি পেলেও শাড়ি বিক্রি হচ্ছে অনেকটা কম দামে। আগে টাঙ্গাইলের তাঁতে শুধু সাধারণ মানের শাড়ি তৈরি হতো। কিন্তু এখন বাহারি নকশার দামি শাড়িও তৈরি হচ্ছে। ঈদের মার্কেটে এবার সফ্ট সিল্ক, জামদানী, সুতি, ধানসিঁড়ি, আনারকলি, গ্যাস সিল্ক, একতারি, দোতারি ও রেশম শাড়ির চাহিদা বেশি। শাড়িগুলো পাঁচশ’ থেকে ৪০ হাজার টাকা দামে বিক্রি হচ্ছে। এখন টাঙ্গাইল শাড়ি নিম্নবিত্তের সীমানা ডিঙ্গিয়ে উচ্চবিত্ত এবং ফ্যাশন সচেতন নারীর মন জয় করে নিতে সক্ষম হয়েছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি দ্রæত জনপ্রিয় হয়ে ওঠছে। টাঙ্গাইল শাড়ির নকশায় বৈচিত্র্য থাকার কারণেই এমন ঘটছে বলে মন্তব্য করেন শাড়ি কিনতে আসা ভারতীয় ব্যবসায়ী অপর্ণা বসাক, নীলু বসাক ও শাবলু বসাক।
টাঙ্গাইল শাড়ির ডিজাইনার ও পাথরাইলের রাধেশ্যাম নীল কমল শাড়ির স্বত্বাধিকারী নীল কমল বসাক জানান, ঈদকে সামনে রেখে প্রতি বছরের মতো এবারও তারা বাহারি ডিজাইনের শাড়ি তৈরি করেছেন। ক্রেতার চাহিদা আর যুগ ও সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে নকশায়ও এনেছেন নতুনত্ব। ক্রেতা-ভোক্তাদের কাছে টাঙ্গাইল শাড়ির যে সুনাম রয়েছে তারা সেই সুনাম ধরে রাখতে বদ্ধ পরিকর।
তিনি আরো জানান, শাড়ির সাথে এবার তারা যোগ করেছেন থ্রি-পিস/ফোর-পিস ও সালোয়ার-কামিজ। সব সময় ব্যবহার উপযোগী আর কাপড়ের মান ভালো বলে এই থ্রি-পিসের উল্লেখযোগ্য চাহিদা দেখা যাচ্ছে।
ঢাকা থেকে সরাসরি শাড়ি কিনতে আসা এক দম্পতি জানান, ঈদ মাকের্টের ভিড় এড়িয়ে নিরিবিলি ও স্বাচ্ছ¡ন্দে নিজের এবং প্রিয়জনকে উপহার দেয়ার জন্য পছন্দের শাড়ি ও থ্রি-পিস কিনতে এখানে এসেছেন। বড় বড় বিপণীবিতান, মার্কেট ও শো-রুমের চেয়ে অনেক কম দামে এখানে উন্নতমানের শাড়ি ও থ্রি-পিস পাওয়া যায়। তাই প্রতি বছর ঈদের শাড়ি ও থ্রি-পিস কিনতে তারা এখানে চলে আসেন। তবে অন্যান্য বছরের চেয়ে এবার শাড়ির দাম কিছুটা বেশি মনে হচ্ছে বলেও জানান তারা।
ঢাকার সাভার থেকে আসা শাড়ি ব্যবসায়ী আসাদুল, জয়নাল আবেদীন, আ. রশিদ জানান, ঈদকে সামনে রেখে তারা শাড়ি নিতে এসেছেন। শাড়ির সাথে এবার যোগ হয়েছে থ্রি-পিস/ ফোর-পিস ও সালোয়ার-কামিজ। এখানকার শাড়ির চাহিদা অনেক। এবং মানও ভালো, দামটাও তুলনামূলক কম। এর আগেও তারা কয়েক হাজার শাড়ি নিয়ে গেছেন। স্টক ফুরিয়ে যাওয়ায় আবারও এসেছেন। তবে গত দু’বছর যাবত তারা টাঙ্গাইলের তৈরি থ্রি-পিস/ফোর-পিস ও সালোয়ার-কামিজও নিচ্ছেন।
প্রখ্যাত তাঁত শাড়ি ব্যবসায়ী যজ্ঞেশ্বর অ্যান্ড কোং-এর সত্ত¡াধিকারী রঘুনাথ বসাক জানান, তাঁতের ব্যবসা পরিচালনা করতে প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। সরকার যদি স্বল্প সুদে তাঁতীদের ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতো তাহলে তাঁত ব্যবসায়ীদের হিমশিম খেতে হতো না। শাড়ির দাম বেশি-ক্রেতাদের এমন অভিযোগ স্বীকার করে তিনি জানান, বর্তমান বাজার দরের সাথে পাল্লা দিয়ে শাড়ি তৈরির উপকরণগুলোর দাম আগের চেয়ে কয়েকগুন বেড়েছে। তাছাড়া শ্রমিক মজুরিও বেশি। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, প্রতি ১০ জন নারীর ৭জন থ্রি-পিস ও সালোয়ার-কামিজ পড়েন। বাধ্য হয়ে তাঁতীরা শাড়ি তৈরির পাশাপাশি থ্রি-পিস/ফোর-পিস ও সালোয়ার-কামিজ তৈরি করছেন। 
সবকিছু ঠিক থাকলে ঈদের বাজারে অতীতের মতো টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি স্বকীয়তা বজায় রেখে ক্রেতার মন জয় করবে বলে মনে করছেন অনেকে। পাশাপাশি সরকারি সহযোগিতা পেলে দেশের বাজারের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও বিপুল পরিমানে টাঙ্গাইলের শাড়ি রপ্তানি করা সম্ভব হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

Post Top Ad

Responsive Ads Here