জাহাঙ্গীর আলম, টাঙ্গাইল
কৃষক পরিবারে জন্ম নিয়ে গ্রামীণ চিত্র পাল্টে দিলেন টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার মামুদপুর মধ্যপাড়া গ্রামের গৃহবধূ রিনা বেগম। জন্ম থেকেই কৃষি কাজের সঙ্গে তার পরিচয়। লেখাপড়ার পাশাপাশি সংসারের কাজ করেছেন, কৃষি কাজে সহযোগিতা করেছেন বাবা-মাকে। বিয়ের পর শ্বাশুড়ির কাছ থেকে বাড়ির আঙ্গিনা ও আশপাশের জায়গায় সবজি চাষ শিখেছেন। ১৯৯১ সালে ৭০ শতাংশ জায়গা বর্গা নিয়ে শ্বাশুড়ির পরামর্শ মতো রাসায়নিক সারের পাশাপাশি জৈব সার ব্যবহার করে সবজিসহ ধান, পাট চাষাবাদ শুরু করেন। ১৯৯৭ সালে বাবার সম্পত্তি থেকে ওয়ারিশ সূত্রে ১১০ শতাংশ জায়গায় নতুন উদ্যমে চাষাবাদ শুরু করেন রিনা বেগম। ২০০৭ সালে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে জোর দেন তিনি। বর্জন করেন রাসায়নিক সার। নিজেই তৈরি করতে থাকেন জৈব সার। একারণে এলাকার অন্য চাষীরা তাকে বিদ্রƒপ করেছেন। অন্যের বিদ্রƒপের তোয়াক্কা না করে সামনের দিকে এগিয়ে যান তিনি।
বিষমুক্ত সবজিসহ বিভিন্ন ফসল ফলিয়ে নিজের ভাগ্য বদল করেছেন রিনা বেগম। এতে শুধু নিজের ভাগ্যই বদলায়নি, পাল্টে দিয়েছেন গ্রামের চিত্রও। অনেকের কাছে রিনা বেগম এখন একটি অনুপ্রেরণা। দীর্ঘদিনের চেষ্টা আর স্বামীর সহযোগিতায় তিনি এখন সফল চাষী। তার এই সফলতা শুধু দেলদুয়ারেই সীমাবদ্ধ নেই, আন্তর্জাতিকভাবেও তিনি একজন আদর্শ চাষী হিসেবে পরিচিত।
কৃষি কাজের পাশাপাশি রিনা বেগম বিভিন্ন ফসলের বীজও সংরক্ষণ করছেন। ২০০২ সালে তার নিজ ঘরের একটি কক্ষে প্রথম ৮ প্রকারের বীজ দিয়ে তিনি তার বীজ সংগ্রহশালা চালু করেন। এখন তার সংগ্রহ শালায় প্রায় ১০০ জাতের সবজি ও ফসলের বীজ রয়েছে। তিনি যেখানেই যান সেখানে যদি কোন ভালো জাতের বীজ পান তা তিনি সংগ্রহ করেন। রিনা বেগম বলেন, বীজ খুব গুরুত্বপূর্ণ। ভালো বীজ হলে ভালো ফসল হয়।
বিষমুক্ত ফসল চাষে রিনা বেগমের দক্ষতা দেখে সরকারি অনুদানে ২০০৯ সালে তাকে সভাপতি করে ‘মামুদপুর মধ্যপাড়া মহিলা সমবায় সমিতি, নামে একটি সমিতি গঠিত হয়। সমিতির সভায় ফসলের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সমাধানের পথ দেখান তিনি। সেখানকার পরামর্শে ওই মহিলারাও তাদের আঙ্গিনাসহ আশপাশের জমিতে বিষমুক্ত ফসল চাষাবাদ শুরু করেছেন।
রিনা বেগমের বিষমুক্ত চাষাবাদের কথা চারপাশে ছড়িয়ে পড়লে সরকারের দৃষ্টি পড়ে তার প্রতি। ফলে ২০১৫ সালে সরকার রিনা বেগমকে আদর্শ কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি দেন। ওই একই বছর জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থা এশিয়ার চারজন কৃষকের মধ্যে রিনা বেগমের নাম আদর্শ কৃষক হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়। বিশ্ব খাদ্য দিবসে থাইল্যান্ডে তার হাতে এ পুরস্কার তুলে দেয়া হয়।
সফল চাষী রিনা বেগমের সাথে কথা বললে তিনি জানান, বিষ পরিবেশ নষ্ট করে ও মানবদেহের মারাত্মক ক্ষতি করে। রাসায়নিক ব্যবহৃত সবজি ও ফল খেয়ে শরীরে যে রোগ হচ্ছে তার চিকিৎসা করতেই অনেকে নিঃস্ব হয়ে পড়েন। এ জন্যই আমি জৈব সার ব্যবহার করে ফসল চাষাবাদ করছি। আমি বেগুন, চাল কুমড়া, ধুন্দল, চিচিঙ্গা, মরিচ, হলুদ, কাকরোল, কচু, লেবু ছাড়াও অন্যান্য মৌসুমে বিভিন্ন মৌসুমি ফসল চাষাবাদ করে থাকি।
তিনি বলেন, পরুষের পাশাপাশি নারীরা আমার মত কাজ করলে সমাজ তথা দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারবে। বিষমুক্ত ফসল আবাদ করে রোগমুক্ত জীবনযাপন করতে আগামী প্রজন্মকে আত্নসচেতন করে গড়ে তুলতে হবে।