জাহাঙ্গীর আলম, টাঙ্গাইল-
মানুষের জন্য রয়েছে নামিদামি আবাসিক হোটেল। অনেক দেশে পোষা কুকুর বা বিড়ালের জন্য হোটেল বা রেস্টুরেন্টের কথা শোনা যায়। কোথাও গড়ে ওঠেনি গরু-মহিষের জন্য আবাসিক হোটেল বা রেস্টুরেন্ট। তবে টাঙ্গাইল জেলার ভূঞাপুর উপজেলার গোবিন্দাসি এলাকায় গরু-মহিষের জন্য আবাসিক হোটেল গড়ে ওঠেছে। এ আবাসিক হোটেলে রয়েছে গরু, মহিষ, ছাগলের জন্য নির্ধারিত স্থান এবং থাকা খাওয়ার পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। বঙ্গবন্ধু সেতুর প্রায় ৬ কি.মি. দূরে নির্মিত জেলার সর্ববৃহত গরুর হাট গোবিন্দাসিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠেছে শতাধিক আবাসিক হোটেল। হোটেলগুলো গড়ে ওঠার ফলে হাটে যেমন সৃষ্টি হয়েছে নতুন কর্মসংস্থান, তেমনি ব্যবসায়ীদের জন্য সৃষ্টি হয়েছে নিরাপদ পরিবেশের গরু, মহিষ, ছাগল ও ভেড়া বেচাকেনার সুযোগ। এ কারণেই অল্প সময়ে গোবিন্দাসি হাট পরিচিতি পাওয়ার পাশাপাশি দেশের ২য় বৃহত্তম পশুর হাটে পরিণত হয়েছে।
এলাকাবাসীদের মতে, গোবিন্দাসী গরুর হাটকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা গরু-মহিষের আবাসিক হোটেল ব্যবসায় এবার মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। একারণে হোটেল কর্তৃপক্ষ শঙ্কাবোধ করছেন।
পবিত্র ঈদুল আজহাকে সামনে রেখে গোবিন্দাসী হাটে প্রচুর গরু-মহিষের আমদানি হলেও ক্রেতা কম থাকায় পাইকাররা গরু-মহিষ নিয়ে অন্যত্র চলে যাচ্ছে।
সরেজমিনে জানা যায়, গরুর হাটকে কেন্দ্র করেই অত্রাঞ্চলের রাজনীতি-অর্থনীতি আবর্তিত হয়। গোবিন্দাসীসহ এসব এলাকার হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের একমাত্র অবলম্বন এই হাট।
প্রতি বছর কোরবানির ঈদ উপলক্ষে গরু-মহিষের আবাসিক হোটেলগুলোর ব্যবসাও থাকে বেশ জমজমাট। হোটেল কর্তৃপক্ষের গরু-মহিষের যাবতীয় দেখভাল করার দায়িত্ব থাকে। নিরাপদে রাখার পাশাপাশি গোসল করানো, মশায় না কামড়ানো এবং খাওয়ানোর যাবতীয় ‘রুম সার্ভিস’ দেয় হোটেল কর্তৃপক্ষ। গোবিন্দাসী হাটকে কেন্দ্র করে এসব অঞ্চলে শতাধিক গরু-মহিষের আবাসিক হোটেল গড়ে ওঠেছে। প্রতিবছর গরু-মহিষের আবাসিক হোটেল থেকে আয়ের টাকায় জীবন চলে প্রায় তিন শতাধিক পরিবারের। কিন্তু এবার হাটে স্থায়ী ইজারা না থাকায় এবং বিক্রি কম হওয়ায় বিক্রেতারা গরু-মহিষ অন্য হাটে নিয়ে যাওয়ায় সবগুলো আবাসিক হোটেল চালু করা হয়নি। সরেজমিনে দেখা গেছে, ৭০টির মতো আবাসিক হোটেলে অল্পকিছু গরু-মহিষ রয়েছে। অন্যগুলো এখনও চালু করা হয়নি।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, ষাটের দশকে গোবিন্দাসীতে ছোট আকারে একটি বাজার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮০ সালের আগে পর্যন্ত গোবিন্দাসী একটি ছোট বাজারই ছিল। চরাঞ্চলের মানুষ প্রয়োজনীয় কেনাকাটা করতো। ১৯৯১ সালের প্রথমদিকে সপ্তাহে দুইদিন রোববার ও বৃহস্পতিবার হাট বসানো হয়। সে সময় সাধারণত বিকেলে হাট বসতো। সন্ধ্যার পর ‘মশাল বাতি’ জ্বালিয়ে রাত ৭-৮টা পর্যন্ত দোকানপাট চালানো হতো। তখন স্থানীয়রা ৮-১০ টা করে করে গরু-ছাগল হাটে তুলে বিক্রি করার চেষ্টা করে। কখনো বিক্রি হয়, আবার কখনো হয়না। ১৯৯৫ সালে সরকারিভাবে গোবিন্দাসী হাটের প্রথম ইজারা হয়। স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা ইকরাম উদ্দিন তারা মৃধা গোবিন্দাসী হাটটি মাত্র ৩২ হাজার টাকায় ইজারা নেন। ইজারার টাকা ওঠাতে তিনি হাটটির ব্যাপক প্রচারণা চালান। গোবিন্দাসী হাটটিতে নদী ও স্থল পথে যাতায়াতের সুবিধা বিবেচনা করে দেশের সিলেট, রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের গরু ব্যবসায়ীদের সাথে যোগাযোগ করেন। তাদেরকে হাটে আনতে নানা রকম প্রণোদনা চালু করেন। যেমন রংপুর, রাজশাহী বিভাগ ও ভারত থেকে গোবিন্দাসী হাটে গরু আনলে যমুনা নদীর পাড়াপাড়ের জন্য ফেরি ফ্রি, হাটে গরুর পাহারা ফ্রি এ রকম হরেক রকম প্রণোদনা। ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাটমুখো করতে ট্রাক নিয়ে বিভিন্ন জেলায় মাইকিং করা হয়।
পাইকাররা শুরুতে ট্রাক ও নৌকায় গরু এনে হাটের আশপাশের মানুষের বাড়ির সামনে এনে জড়ো করে রাখতেন। ঝড়-বৃষ্টির সময় এসব বাড়ির গোয়ালঘরেই জায়গা হতো পাইকারদের কিছু গরুর। আশ্রয় পেতেন পাইকাররাও। বিনিময়ে তারা বাড়ির মালিককে নামমাত্র কিছু অর্থ দিতেন। এভাবে টাকা রোজগারের এই সহজ সুযোগ ও পাইকারদের চাহিদার কারণে হাটের আশপাশের বাসাবাড়ির মালিকরা তাদের খোলা জায়গায় টিনের ছাপড়া ঘর তুলে দেয় হাটে আসা গরু-মহিষের জন্য। ভাড়ার বিনিময়ে গরু রাখা শুরু হয় সেখান থেকেই। পরবর্তীতে এসব ঘরই পরিচিতি লাভ করে গরু-মহিষের আবাসিক হোটেল হিসেবে। দিন দিন বাড়তে থাকে এ হোটেলের সংখ্যা। হোটেলের গন্ডি ছড়িয়ে পড়ে গোবিন্দাসীর আশপাশের খানুরবাড়ি, ভালকুটিয়া, কুকাদাইর, রাউৎবাড়ি, জিগাতলা, বাগবাড়ি, স্থলকাশি, মাটিকাটা ও চিতুলিয়াপাড়াসহ অন্তত ১০-১২টি গ্রামে। গরু-মহিষের আবাসিক সুবিধা থাকায় হাট শুরুর প্রায় ২-৩দিন আগেই হাটে এসে এসব হোটেলে গরু-মহিষ রাখেন পাইকাররা। আর এ জন্য হোটেল মালিককে গরু প্রতি প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ টাকা দিতে হতো। কিন্তু গত কয়েক বছরে হাটে পাইকারের সংখ্যা কমে যাওয়ায় আবাসিক হোটেলের ভাড়া কমিয়ে গরু প্রতি ১০ টাকা করা হয়েছে। গোবিন্দাসী হাটে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকার ও ব্যাপারীরা গরু বেঁচা-কেনা করতে আসেন। তাদের থাকার জন্য এখানে যেমন আবাসিক হোটেল রয়েছে তেমনি তাদের গরু, মহিষ ও ছাগল নিরাপদে রাখার জন্যও রয়েছে গরু-মহিষের আবাসিক হোটেল। এসব গরু-মহিষের আবাসিক হোটেলের আয় থেকে যাঁরা সংসারের চাকা সচল রাখছেন তাদের অবস্থাও এবার খুব ভালো নয়। তবে, তারা আশা করছেন, ঈদের বাজার জমে উঠলে তাদের ভাগ্য বদলে যেতে পারে।