সময় সংবাদ ডেস্ক:
রিক্রিয়েশন সেন্টারের নামে সিঙ্গাপুর ও সিন সিটি লাসভেগাসের আদলে খোদ রাজধানীতে গড়ে তোলা হয় ক্যাসিনো (জুয়ার আস্তানা)। ঝকঝকে আলোকচ্ছটায় রমরমা এসব জুয়ার আড্ডায় প্রতিদিন উড়ত কোটি কোটি টাকা। ক্যাসিনোতে টাকা দ্বিগুণ করার প্রলোভনে পড়ে প্রতি রাতেই জুয়ার বোর্ডে সর্বস্ব হারিয়ে মানুষের চোখ ভিজলেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে নেপালি জুয়াড়িচক্র।
ক্ষমতাসীন দলের কিছু নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দুর্নীতিবাজ কিছু সদস্যের মদদে মূলত এ নেপালিরাই নিয়ন্ত্রণ করত ক্যাসিনো সাম্রাজ্য। বিদেশ থেকে প্রশিক্ষিত জুয়াড়ি এনে এই নেপালিরাই রাজধানীর বিভিন্ন ক্লাব ও রেস্টুরেন্ট ব্যবসার আড়ালে সাজিয়েছে পশ্চিমা ধাঁচের ক্যাসিনো ব্যবসা।
জুয়া ছাড়াও ইয়াবা-মদসহ বিভিন্ন মাদক সেবনের আখড়ায় পরিণত হয় এসব ক্যাসিনো।
জানা গেছে, ১১ নেপালির হাত ধরে বাংলাদেশে ক্যাসিনোর বিস্তার লাভ করে। তারা হলেন- দিনেশ শর্মা, রাজকুমার, বিনোদ, দিনেশ কুমার, ছোট রাজকুমার, বল্লভ, বিজয়, সুরেশ বাটেল, কৃষ্ণা, জিতেন্দ্র ও নেপালি বাবা।
রাজধানীতে যে কটি আধুনিক বৈদ্যুতিন ক্যাসিনো জুয়ার বোর্ড পরিচালিত হতো সেগুলোর বেশিরভাগই অপারেটিং সিস্টেম দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন তারাই। চীন ও নেপাল থেকে মোটা বেতনে অভিজ্ঞ নারী-পুরুষ এনে এরাই সচল রাখেন ক্যাসিনোর চাকা। এ ১১ নেপালির কেউ কেউ ইতোমধ্যে ক্যাসিনোর মালিকও হয়েছেন।
ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠা ক্যাসিনোর মধ্যে অন্যতম মতিঝিলের দিলকুশা ক্লাব ও মোহামেডান ক্লাব, গুলিস্তানের ওয়ান্ডারার্স ক্লাব ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাব, ফকিরাপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব, নিউমার্কেট এলাকার অ্যাজাক্স ক্লাব, ধানমন্ডির ধানমন্ডি ক্লাব, কলাবাগান ক্লাব, গুলশান লিংক রোডের ফু-ওয়াং ক্লাব, মালিবাগের সৈনিক ক্লাব ও বনানীর গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ।
গত বুধবার ইয়ংমেনস ক্লাব, ওয়ান্ডার্স ক্লাব, বনানীর গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ ও গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবে অভিযান চালিয়ে ১৮২ জন জুয়াড়ি ও ক্যাসিনোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আটক করে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। জব্দ করা হয় ক্যাসিনোর উপকরণ ও মাদক। ক্লাবের আড়ালে আরও যেসব জায়গায় ক্যাসিনো আছে গা বাঁচাতে প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যাসিনো বোর্ড আপাতত বন্ধ রেখেছে কর্তৃপক্ষ।
জানা গেছে, মতিঝিলের দিলকুশা ক্লাব ও এলিফ্যান্ট রোডের এজাক্স ক্লাবের নিয়ন্ত্রক হলেন নেপালের বাসিন্দা রাজকুমার। মোহামেডান ক্লাব ও বনানীর আহম্মেদ টাওয়ারে অবস্থিত গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ নামে ক্যাসিনোর নিয়ন্ত্রক আবুল কাশেম এবং এমরান। গুলশানের ফুওয়াং ক্লাবের মালিক নুরুল ইসলাম ও টমাস বাবু; প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার তুষার। মালিবাগের সৈনিক ক্লাবের নিয়ন্ত্রক সুরেশ বাটেল, জিতেন্দ্র জসিম ও এবিএম গোলাম কিবরিয়া।
গ্যাম্বলিংয়ের (জুয়া খেলা) জগতে ডন হিসেবেই পরিচিত দিনেশ নেপালের বাসিন্দা দিনেশ শর্মা ও রাজকুমার। এদের পার্টনার দেলোয়ার নামে এক বাংলাদেশি। এ ছাড়া শক্তিশালী এ চক্রের অন্যতম সদস্য হিসেবে রয়েছেন বাবা, বল্লভ, বিজয় নামে ৩ শীর্ষ জুয়াড়ি। এ চক্রটিই মূলত নিয়ন্ত্রণ করছে ঢাকার ক্যাসিনো বাণিজ্য। তাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসা প্রশিক্ষিত চারশরও বেশি নেপালি জুয়াড়ি অনুমতি ছাড়াই দেশের বিভিন্ন নামিদামি রেস্টুরেন্ট ও ক্লাবভিত্তিক ক্যাসিনোয় কাজ করছেন।
আরও জানা গেছে, এ চক্রের সদস্যরা জনবহুল এলাকা টার্গেট করে প্রথমে রেস্টুরেন্ট বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো একটি ভবনের এক বা একাধিক ফ্লোর বা কক্ষ ভাড়া নেয়। ধীরে ধীরে সেই ব্যবসার অন্তরালে গড়ে তোলে ক্যাসিনোর র্যাকেট। জমজমাট হতেই তারা মোটা টাকার বিনিময়ে অন্য কারও কাছে সেটি হস্তান্তর করে নতুন ভবন টার্গেট করে। একই পদ্ধতিতে সেখানে গড়ে তোলে লাস ভেগাসের আদলে বিশাল জুয়ার আখড়া। এভাবে তারা রাজধানীতেই অর্ধশতাধিক ক্যাসিনো গড়ে তোলে। এই পুরো চক্রটিকে পৃষ্ঠপোষকতা করেন ঢাকা মহানগর যুবলীগের একজন প্রভাবশালী নেতা। তিনিই ক্যাসিনো বাণিজ্যের মূল চাবিকাঠি। ২০১৭ সালে প্রভাবশালী এ নেতার বিরুদ্ধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করেছিল একটি গোয়েন্দা সংস্থা।
ঢাকার ক্যাসিনো সাম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রকদের আরেক অন্যতম ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। তিনি গত বুধবার রাতে অবৈধ অস্ত্র-মাদকসহ র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন। এর পর একে একে গোল্ডেন ঢাকা বাংলাদেশ, ওয়ান্ডার্স ক্লাব ও গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্লাবে অভিযান চালিয়ে ক্যাসিনোগুলো সিলগালা করে দেন আদালত।
র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, ক্রীড়া সংগঠনের নামে এতদিন এসব ক্লাবে ক্যাসিনো এবং মাদকের আখড়া গড়ে উঠেছিল। ক্যাসিনোতে যে চীন ও নেপালি নাগরিক পাওয়া গেছে তারা চাকরি করেন বলে জানিয়েছেন। আদৌ তাদের ওয়ার্ক পারমিট আছে কিনা, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ক্যাসিনোর সঙ্গে যারাই জড়িত থাকুক কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।