ডাকাতের ছেলে থেকে যেভাবে হয়ে উঠলো রাজশাহীর আড়ানীর পৌর মেয়র - সময় সংবাদ | Popular Bangla News Portal

Breaking

Post Top Ad

Responsive Ads Here

শুক্রবার, জুলাই ০৯, ২০২১

ডাকাতের ছেলে থেকে যেভাবে হয়ে উঠলো রাজশাহীর আড়ানীর পৌর মেয়র


  


ওবায়দুল ইসলাম রবি, রাজশাহী প্রতিনিধিঃ


রাজশাহীর বাঘা উপজেলায় কোন এক সময় পুলিশের দালাল হিসেবে রাস্তায় টোল আদায় করতো বর্তমান আটককৃত আড়ানীর পৌর মেয়র। প্রথম জীবনে চাঁদা তুলে সংসার পরিচালনা করলেও মেয়র হওয়ার পর ঘড়ে বাসে কোটি টাকা আয়। একসময় তাঁর আয়ের উৎস ছিলো বাড়িতে পাঠা পোষা। একসময় সে ভারত থেকে গরু, চিনি ও চোরাচালান থেকে চাঁদা ওঠাতে শুরু করে।


তার ফেলে আসা ইতিহাস তথ্য থেকে জানাযায়, মুক্তার আলী ‘নইম ডাকাতের ছেলে। স্বাধীনতা পর এলাকার মানুষ এতটাই অতিষ্ঠ হয়ে নইমকে ডাকাতকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে মেরে ফেলে। মুক্তারের বড় ভাইয়ের নাম কালু এলাকার মানুষকে অত্যচার করতো। গত ৫ বছর আগে এলাকার এক ব্যক্তি ক্ষুব্ধ হয়ে হাসুয়ার কোপে ঘটনাস্থলেই মারা যায় কালু। অভাব-অনটনের সংসারে অষ্টম শ্রেণি পার হতে পারেননি মুক্তার আলী। 


সে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সদস্য নির্বাচিত হয়, পরে পৌরসভার কাউন্সলর। তারপর তাকে দমিয়ে রাখা যায়নি তাকে। তার কাছে ছিলো অস্ত্র, গুলি এবং মাদকেরও মজুত। মুক্তারের নেতৃত্বে পৌর এলাকায় তার ত্রাসের রাজত্ব, গড়ে তুলেছিলেন মুক্তার বাহিনী। আড়ানীতে মুক্তারের ত্রাসের রাজত্ব, কখনও নির্যাতন অথবা ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রতিহত করতো। জনপ্রতিনিধি হয়েই হয়েছেন বিপুল অর্থ-সম্পদের মালিক। চলাচল করেন বেপরোয়া। প্রায় সব সময়ই মদ্যপ অবস্থায় থেকে মারধর করেন যাকে ইচ্ছে। সবশেষ এক কলেজশিক্ষককে মারধর করেই ফেঁসে গেছেন আড়ানীর ত্রাস মুক্তার। ঘটনাটি গেল মঙ্গলবার রাতের। মেয়রের প্রভাব খাটিয়ে লকডাউনের মধ্যেও দোকান খুলে হালখাতা করছিলেন তাঁর বেয়াই শামীম উদ্দিন।


মুক্তার আলী ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। কিন্তু নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে পরের বছরই তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। পরে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার হয়। ২০০৬ সালে আড়ানী ইউনিয়ন পরিষদ পৌরসভা হয়ে যায়। তার আগে আড়ানী ইউপির সদস্য হয়েছিলেন মুক্তার আলী। পরবর্তীতে পৌরসভার কাউন্সিলর হন। দিনে হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগের বড় নেতা। ২০১৫ সালে পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পান পৌর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি বাবুল হোসেন।


মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার আগের রাতে রহস্যজনকভাবে বিষক্রিয়ায় তাঁর মৃত্যু হয়। মনোনয়ন পেয়ে যান মুক্তার আলী। হয়ে যান মেয়রও। এরপর আরও বেপরোয়া হয়ে যান মুক্তার আলী। চলতি বছরের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পান পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি শহিদুজ্জামান। কিন্তু ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী হয়ে ভোটে থেকে যান মুক্তার আলী। হামলা-মামলা করেন নৌকার প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর। ঘটে গোলাগুলিরও ঘটনা। তখন মুক্তার আলীর বিরুদ্ধেও একটি মামলা হয়। সেই মামলায় জামিন না নিলেও নির্বিঘ্নেই তিনি শপথ নেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করেনি। দুটি ঘটনার যোগসূত্র কী?


পৌর নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার আগের রাতে বিষক্রিয়ায় মারা যান আওয়ামী লীগ নেতা বাবুল হোসেন। রাত জেগে বাবুলের মদপানের অভ্যাস ছিল। এলাকায় এখনও গুঞ্জন আছে, মদের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দিয়ে বাবুলকে মেরে ফেলা হয়। এ বছর পৌর নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশী ছিলেন বাবুলের ছেলে ছাত্রলীগ নেতা রিবন আহমেদ বাপ্পী। তাঁর মনোনয়ন পাবার সম্ভাবনাও ছিলো। মনোনয়নপত্র বিতরণের কয়েক দিন আগে হঠাৎ এক তরুণী দাবি করে বসেন, বাপ্পী তাঁকে ধর্ষণ করেছেন। এ নিয়ে বাপ্পীর বিরুদ্ধে থানায় মামলা হয়। মামলার বাদী ওই তরুণী সম্পর্কে মেয়র মুক্তার আলীর ভাগনি।


আড়ানী পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুলল মতিন বলেন, বাবুলের মত্যুটা ছিলো রহস্যজনক। এই মৃত্যুর সঙ্গে মুক্তারের যোগসূত্র আছে বলে এলাকায় গুঞ্জন রয়েছে। পরে বাবুলের ছেলে বাপ্পীকে তো ফাঁসিয়েই দেয়া হলো পরিকল্পিতভাবে। সে কারণে নির্বাচনে বাপ্পীও মনোনয়ন পায়নি। পুলিশ তাঁর স্ত্রী এবং দুই ভাতিজাকে গ্রেপ্তার করেছে। লাপাত্তা হন কোটিপতি সেই মেয়র। এই মেয়রের নাম মুক্তার আলী। তিনি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী পৌরসভার মেয়র। গত বুধবার ভোরে মুক্তার এর স্ত্রী সহ ২ ভাতিজাকে গ্রেপ্তারের পর আজ শুক্রবার ভোরে তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।


মেয়রকে না পাওয়া গেলেও বাড়িতে মেলে একটি অবৈধ বিদেশী পিস্তল, একটি ওয়ান শ্যুটার গান, দেশে তৈরী একটি বন্দুক, একটি এয়ার রাইফেল, শটগানের ২৬ রাউন্ড গুলি, চারটি পিস্তলের ম্যাগজিন, পিস্তলের ১৭ রাউন্ড গুলি, চারটি গুলির খোসা, ১০ গ্রাম গাঁজা, হেরোইন, ২০ পিস ইয়াবা, নগদ ৯৪ লাখ ৯৮ হাজার টাকা এবং মেয়রের দুটি সই করা ১৮ লাখর চেক। তিন বছর আগেও মুক্তার আলীর আধাপাকা টিনশেড বাড়ি ছিলো। এখন সেখানে আভিজাত্যে দোতলা বাড়ি। ওই বাড়িতে রয়েছে এসি, দামি আসবাব, প্রাইভেটকার এবং ০৩টি মোটরসাইকেল। মুক্তার জমিও কিনেছে নামে-বেনামে। তার ছেলে রাজুকে আহমেদকে একটি হার্ডওয়্যারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গদে দিয়েছে। অনুসন্ধানে পাওয়াযায় তার এই অঢেল সম্পদের চোঞ্চল্যকর তথ্য।


এবিষয়ে স্থানীয়রা জানান, পৌরসভার সব কাজ তিনি দুই আওয়ামী লীগ নেতাকে দিয়ে করান। এদের একজন পৌর আ’মী লীগের সাধারণ সম্পাদক মামুন আলী এবং অন্যজন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ওয়াহেদ সাদিক কবীর। ওয়াহেদ পেশায় শিক্ষক হলেও অন্যজনের লাইসেন্স নিয়ে ঠিকাদারী করেন। ওয়াহেদ ও মামুনের কাছ থেকেই কাজের কমিশন পেয়ে থাকেন মেয়র মুক্তার আলী। ওই দুই নেতার সাথে যোগাযোগ করা হলে পৌর আ’মী লীগের সাধারণ সম্পাদক মামুন আলী বলেন, তিনি ছোট ঠিকাদার, টেন্ডারে অংশ নিয়ে স্বচ্ছভাবেই কাজ করে। ওয়াহেদ সাদিক কবীর মোবাইল ফোনে বিস্তারিত কথা বলতে চাননি। তবে সে বলে তিনি একজন শিক্ষক মানুষ। তার লাইসেন্স নেই।


আড়ানী থেকে রুস্তমপুর পর্যন্ত রাস্তা সংষ্কারে ৪৫ লাখ টাকার দরপত্র আহ্বান করেছিল পৌর কর্তৃপক্ষ। কিন্তু কোন কাজ না করেই বিল তুলে নেয়া হয়েছে। সেই রাস্তা পরে সংষ্কার করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। এই রাস্তা থেকেই মেয়র অন্তত ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। আড়ানী পৌরসভায় ২টি হাট আছে। হাট ২টি কখনও স্বচ্ছভাবে ইজারা দেয়া হতো না। সেখান থেকে আসে লক্ষ লক্স টাকা। এলাকার সুদ, মাদকের কারবার এবং অবৈধ দোকানপাট থেকে টাকা পান মুক্তার আলী। পৌরসভার তেঁতুলতলা এলাকায় ট্রাক থেকে তোলা হয় টাকা। পৌর এলাকার অসংখ্য মানুষ মুক্তার আলীর নির্যাতন-হয়রানির শিকার। তাঁর মতের সঙ্গে না মিললে তিনি পৌরসভা থেকে কাউকে নাগরিকত্ব, জন্ম সনদ কিংবা প্রত্যয়নপত্রও দেন না। নৌকার ভোট করার কারণে মনোরঞ্জন সরকার নামে এক ব্যক্তি পৌরসভা থেকে একটি প্রত্যয়নপত্র সংগ্রহ করতে পারেননি। মেয়রের এ ধরনের কর্মকা-ে ক্ষুব্ধ কাউন্সিলররাও। সহ্য করতে না পেরে জিল্লুর রহমান নামে এক কাউন্সিলর তো মেয়র মুক্তার আলীকে পিটিয়েছিলেন। দলের নেতারা কী বলছেন?


আড়ানী পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুলল মতিন বলেন, মেয়র মুক্তার আলী সাথে পৌর আ’লীগ সম্পাদক মামুন কোন ভাবে অন্যায়ের সাথে জড়িত না। এই মেয়র এলকার জন্য দুর্ভাগ্যের। আড়ানীর মানুষ খুব ঠা-া প্রকৃতির। রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘এক সময় মুক্তার আলী আওয়ামী লীগের ভাল কর্মী ছিল। পরবর্তীতে তাঁকে আজকের মুক্তার হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। কারা তাঁকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে এমন সন্ত্রাসী করে তুলল, সেটা তো এখন বড় প্রশ্ন।’


মুক্তার আলীর বাড়ি থেকে কোটি টাকা, অস্ত্র এবং মাদকদ্রব্য উদ্ধারের ঘটনায় থানায় আলাদা আলাদা মামলা হয়েছে। সেই অভিযানের আগে থেকেই মুক্তার আলী লাপাত্তা। বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। আগের দিন মেয়রের স্ত্রী জেসমিন আক্তার ও দুই ভাতিজা সোহান এবং শান্তকে পুলিশ আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠিয়েছে। শুক্রবার ভোর ৫টায় মেয়রকেও গ্রেপ্তারের করা হয়েছে। 


রাজশাহীর পুলিশ সুপার (এসপি) এবিএম মাসুদ হোসেন সংবাদ সম্মলনে জানান, মেয়রের হাতে মারধরের শিকার শিক্ষক মনোয়ার হোসেন তাঁর বিরুদ্ধে একটি মামলা করেছেন। এছাড়া অস্ত্র এবং মাদক উদ্ধারের ঘটনায় পুলিশ দুটি মামলা করেছে। এর আগে তাঁর বিরুদ্ধে ৫টি মামলা আছে। সবমিলিয়ে এখন আটটি মামলার আসামি মেয়র মুক্তার। আজ শুক্রবার সকালে তাঁকে গ্রেপ্তার হয়েছে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর এলাকা থেকে।

Post Top Ad

Responsive Ads Here