বিদেশের বন্দরে আটকে আছে আমদানিকারকদের ১০ লাখ টন তুলা | সময় সংবাদ |
সময় সংবাদ ডেস্ক:
বিদেশের বন্দরগুলোতে বাংলাদেশের আমদানিকারকদের প্রায় ১০ লাখ টন তুলা আটকে আছে। বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) প্রাক্কলন অনুযায়ী আটক থাকা তুলার অর্থমূল্য প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার।
আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ দুই প্রেক্ষাপটেই সুতা উৎপাদনে তুলা সংকটের মুখে পড়ছে মিলগুলো। এ ধারা অব্যাহত থাকলে উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
তুলা আটকে থাকার কারণ হিসেবে, বিশ্বব্যাপী জাহাজ ও কনটেইনার সংকট, অন্যদিকে দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রামে এসে পড়তে হয় জটে। এ দুই কারণে বাংলাদেশে আমদানি পণ্যের চালান নিয়ে আসতে আগ্রহী নয় শিপিং কোম্পানিগুলো। ফলে তুলা আমদানি সম্পন্ন করতে দেশের রফতানিমুখী সুতা উৎপাদনকারী স্পিনিং মিলগুলোর অতিরিক্ত সময় লাগছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে তুলা আমদানি হয়েছে ৭৫ লাখ বেল। ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি ৭৬ লাখ বেল ছাড়িয়ে গেছে। চলতি অর্থবছর শেষে আমদানি ৯০ লাখ বেল ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রক্ষেপণ রয়েছে। কিন্তু আমদানি তুলার প্রাপ্তি নিয়ে অনিশ্চয়তা স্পিনিং মিল মালিকদের ফেলে দিয়েছে দুশ্চিন্তায়।
বিটিএমএ সূত্রে জানা গিয়েছে, তুলা আমদানিতে বহুমুখী সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে স্পিনিং মিলগুলোকে। বিশ্বব্যাপী জাহাজ, কনটেইনার সংকটসহ রয়েছে বন্দরজট। দেশে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরেও রয়েছে ফিডার ভেসেলের সংকটসহ জটের সমস্যা। সব মিলিয়ে অনেক শিপিং কোম্পানি বাংলাদেশী পণ্য পরিবহনে আগ্রহী হচ্ছে না।
বিটিএমএর হিসাব অনুযায়ী, আনুমানিক ১০ লাখ টন তুলা বিদেশের বন্দরগুলোতে জটে আটকে আছে। প্রতি টন সাড়ে ৩ হাজার ডলার হিসেবে আটকে থাকা তুলার অর্থমূল্য হয় সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার। বেশির ভাগ তুলাই আটকে আছে আফ্রিকা অঞ্চলের বন্দরে, যা মোট আটকে থাকা তুলার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বন্দরে আছে ১২ শতাংশ। এছাড়া সেন্ট্রাল এশিয়ায় আছে ১০-১২ শতাংশ। ভারতে আছে ১৫-২০ শতাংশ। বাকিটা আটকে আছে অন্যান্য বন্দরে।
বিটিএমএ সভাপতি মোহম্মদ আলী খোকন বলেন, বিদেশের বন্দরগুলোতে আটকে থাকা প্রায় ১০ লাখ টন তুলার মূল্য দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৩ বিলিয়ন ডলার। নিজস্ব ভাড়া করা জাহাজে হলেও আটকে থাকা তুলা নিয়ে আসার জন্য আমরা চেষ্টা করছি। সমস্য হলো বাল্ক শিপ থাকলেও বিশ্বব্যাপী কনটেইনার শিপের ঘাটতি আছে। আবার বাল্ক শিপে তুলা ভিজে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। কনটেইনারে একজনের তুলার সঙ্গে অন্যজনের তুলা মিলে গেলে পরে কার কোন তুলা সেটা চিহ্নিত করা জটিল হয়ে যাবে।
একটি পোর্ট থেকে তিন-চারজন আমদানিকারক একজোট হয়ে যদি আনা যায়, সেক্ষেত্রে বাল্ক শিপে আনা সম্ভব হলেও তা বেশ ব্যয়বহুল জানিয়ে মোহম্মদ আলী খোকন বলেন, বাল্ক শিপের ভাড়া দিনপ্রতি ৪০ হাজার ডলার। যেদিন থেকে জাহাজ রওনা হবে, সেদিন থেকে ভাড়া কার্যকর।
আবার জাহাজের তেল খরচের দায়ও আমদানিকারকদের। আফ্রিকার বন্দর থেকে একটি বাল্ক শিপ নিয়ে আসতে মোট ২২ লাখ ডলার খরচ পড়বে। ৫০ হাজার টনের সক্ষমতার বাল্ক জাহাজে তুলা আনা যাবে ২৫ হাজার টন। এসব জটিলতার পরও আমরা চেষ্টা করছি বিকল্প পন্থায় আটকে থাকা তুলা নিয়ে আসার জন্য।
দেশে বিটিএমএ সদস্য স্পিনিং মিল ৪৩০টিরও বেশি। এ মিলগুলোর কেনা তুলাসহ অন্যান্য কাঁচামাল দেশে আমদানিতে অতিরিক্ত সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাঁচ-ছয় মাস সময় লাগছে। কেনা তুলা যথাসময়ে দেশে পৌঁছতে না পারার কারণে মিলগুলোর উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কাও সৃষ্টি হয়েছে।
বাংলাদেশে কাঁচা তুলা আমদানি হচ্ছে মূলত যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, পূর্ব ও পশ্চিম আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, সিআইএসভুক্ত দেশসহ অন্যান্য দেশ থেকে। স্পিনিং মিলগুলোর কারিগরি প্রেক্ষিত বিবেচনায় ২৪ ঘণ্টা চালু রাখতে হয়। উৎপাদন অব্যাহত রাখার স্বার্থে মিলগুলোয় কাঁচা তুলার নিরবচ্ছিন্ন জোগান অব্যাহত রাখার কোনো বিকল্প থাকে না। এছাড়া উৎপাদিত সুতা তৈরি পোশাক খাতে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সরবরাহের লক্ষ্যেও স্পিনিং মিলগুলোকে অব্যাহতভাবে কাঁচা তুলা আমদানি করতে হয়।
বিটিএমএ জানিয়েছে, বর্তমানে তুলা আটকে থাকা বস্ত্র খাতের বড় সমস্যার কারণ হলেও দেশের অভ্যন্তরে তুলা নিয়ে অনেক ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। অন্য কোনো দেশের কাঁচা তুলার জন্য প্রযোজ্য না হলেও কৃষি মন্ত্রণালয়ের দিকনির্দেশনা ও আইনে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা তুলা বন্দর থেকে খালাসের আগে পরিশোধন বা ফিউমিগেশন করতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের তুলা জাহাজ থেকে নামার পর ফিউমিগেশন প্রক্রিয়া সম্পন্ন শেষে ৭২ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় ফলাফল পেতে। ফলাফল প্রাপ্তি সাপেক্ষে সার্টিফিকেট ইস্যুর পর শুল্ক কর্তৃপক্ষ কাঁচা তুলার মূল্যায়ন কার্যক্রম শুরু করে। এসবই আমদানি করা কাঁচা তুলা খালাস পরিস্থিতিকে আরো জটিল করেছে।
এদিকে কাঁচা তুলা আমদানিতে দীর্ঘসূত্রতার পাশাপাশি আমদানি অনুমতি (আইপি) নিয়েও জটিলতা রয়েছে। বিটিএমএর স্পিনিং মিলগুলোকে কাঁচা তুলা আমদানির আগে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং থেকে আইপি সংগ্রহ করতে হয়। এক্ষেত্রে আইপির মেয়াদ নির্ধারণ করে দেয়া হয় সাধারণত চার মাস। পরবর্তী সময়ে কোনো কারণে সংশ্লিষ্ট মিলগুলো আইপির বিপরীতে তুলা আমদানি করতে সক্ষম না হলে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় ফি প্রদান সাপেক্ষে আইপির মেয়াদ বাড়াতে হয়।
কিন্তু বাড়ানো মেয়াদের মধ্যেও তুলা আমদানি সম্ভব হচ্ছে না অনেক ক্ষেত্রে। চলমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বর্তমানে তুলা আমদানিতে মিলগুলোর ছয়-সাত মাস বা তারও বেশি সময়ের প্রয়োজন হচ্ছে। অন্যদিকে ট্রানজিট ও চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজজটের কারণে আমদানি করা তুলা বাংলাদেশে পৌঁছতে ৯-১০ মাস সময় লাগছে।
এদিকে বাড়ানো আইপির মেয়াদেও তুলা আমদানি সম্পন্ন না হওয়ায় মিলগুলোকে আমদানীকৃত তুলা বিশেষ আদেশ গ্রহণের মাধ্যমে ছাড় করতে হয়। প্রায় ক্ষেত্রেই এ ধরনের বিশেষ আদেশপ্রাপ্তি সময়সাপেক্ষ হয়ে থাকে। যার কারণে বন্দরে ড্যামারেজ, হয়রানি, উচ্চমূল্যে স্থানীয় বাজার থেকে তুলা কেনার কারণে সুতার উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, আর্থিক ক্ষতি, ব্যবসার খরচসহ খালাসে অতিরিক্ত সময়ে মিলগুলোর উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে বলে জানিয়েছে বিটিএমএ।